আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): গাজায় যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছু অঞ্চল উন্মুক্ত রেখে সীমান্তসংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকাকে নেওয়া হয় হলুদ রেখার আওতায়। এই রেখার ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই ফিলিস্তিনিদের। অথচ সেখানে একসময় তাদের বসতি ছিল; জলপাই, আঙুর, স্ট্রবেরিসহ নানা ফলের বাগান।
এখন ইসরায়েলের সামরিক যানের দাপট আর সেনাদের বুটের পদধ্বনি। কেউ প্রবেশের চেষ্টা করলে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে, বিশাল সীমান্ত এলাকা কি দখলে নিল ইসরায়েল? এমনটা হলে উপত্যকার অর্ধেকের কম এলাকায় থাকতে বাধ্য হবে ফিলিস্তিনিরা।
হলুদ রেখার কারণে মিসরের সঙ্গে গাজার যে সরাসরি সীমান্ত, সেটি আর থাকছে না। দক্ষিণের রাফা শহর পুরোটাই বিলীন; খান ইউনিসের বড় অংশ ইসরায়েলের দখলে চলে গেছে। দ্য গার্ডিয়ানের এক বিশেষ প্রতিবেদনে গত রোববার বলা হয়, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ হলুদ রঙের কংক্রিট দিয়ে রেখা অঙ্কন করে দিচ্ছে। প্রতি ২০০ মিটার পরপরই হলুদ ব্লক চিহ্ন দিয়ে জানান দেওয়া হচ্ছে যে এটি সীমানারেখা।
যুদ্ধবিরতির অস্থায়ী রেখা গাজাকে প্রায় অর্ধেক করে ফেলেছে। পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্তজুড়ে আইডিএফ অসংখ্য সামরিক ফাঁড়ি তৈরি করেছে। সেই সঙ্গে রেখার দিকে এগিয়ে আসা যে কাউকে গুলি করছে।
গাজার ৩১ বছর বয়সী মোহাম্মদ খালেদ আবু আল-হুসেনের বাড়ি খান ইউনিসের উত্তরে হলুদ রেখার কাছাকাছি এলাকায়। তিনি বলেন, আমরা যখন বাড়ির কাছে পৌঁছাই, তখনই প্রতিটি দিক থেকে গুলি আসতে শুরু করে।
কখনও কখনও ছোট ছোট ড্রোন, কোয়াডকপ্টার আমাদের ওপরে ভেসে বেড়ায়; গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। হঠাৎ আমরা প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের কবলে পড়ি। আমরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ি এবং গুলি থামা পর্যন্ত সেখানে থাকি।’ তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, যুদ্ধ শেষ হয়নি। যদি এখনও বাড়ি ফিরতে না পারি, তাহলে যুদ্ধবিরতির কী লাভ?’
ইসরায়েল গত রোববার জোর দিয়ে বলেছে, তারা গাজার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মন্ত্রীদের বলেছেন, তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন, কোথায় ও কখন আক্রমণ করতে হবে।
যুদ্ধবিরতির দুই সপ্তাহ পার হলেও প্রতিদিন গড়ে ২০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছেন। অনেকে হলুদ রেখার কাছে গিয়ে মারা যাচ্ছেন। ফলে বাস্তুচ্যুতরা ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত বৃহৎ এলাকায় ফিরে যেতে পারছেন না। এসব ঘটছে যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে।
এটি দ্বিতীয় পর্যায়ে যাওয়ার পথে রাজনৈতিক বাধা এখনও বিশাল, যার মধ্যে হামাসকে নিরস্ত্র করে বহুজাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ও রয়েছে। নেতানিয়াহুর শাসক জোটের কট্টরপন্থি শরিকরা গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার ও এর নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক বাহিনীর মোতায়েনের তীব্র বিরোধিতা করছে।
গণমাধ্যমে ‘নতুন সীমান্ত’ বলে প্রচারণা
এ অচলাবস্থার মধ্যেই মূলত হলুদ রেখাটি আরও স্থায়ী রূপ নিতে চলেছে। ইসরায়েলের গণমাধ্যমে এটিকে ক্রমবর্ধমানভাবে ‘নতুন সীমান্ত’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। ইয়েদিওথ আহরোনোথ পত্রিকায় সংবাদদাতা ইওভ জিতুন ভবিষ্যদ্বাণী করেন– হলুদ রেখাটি ‘একটি উচ্চ ও পরিশীলিত বাধায় পরিণত হতে পারে, যা গাজা উপত্যকাকে সংকুচিত করবে, পশ্চিম নেগেভকে প্রসারিত করবে এবং সেখানে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের সুযোগ দেবে।’
রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভোকেসি গ্রুপের সভাপতি ও সাবেক মার্কিন সাহায্য কর্মকর্তা জেরেমি কোনিনডিক বলেন, কার্যত এটি গাজার ক্রমবর্ধমান দখলের মতো দেখাচ্ছে।
গত ১০ অক্টোবর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। শর্ত অনুযায়ী, গাজার উপকূলীয় কিছু এলাকা ছেড়ে হলুদ রেখায় গিয়ে অবস্থান করবে আইডিএফ। এতে গাজা উপত্যকার ৫৩ শতাংশ এলাকা ইসরায়েলের দখলে চলে গেছে। বিবিসির স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত রেখা থেকে নতুন হলুদ চিহ্নের রেখা কয়েকশ মিটার সামনে স্থাপন করা হয়েছে। এতে গাজার উল্লেখযোগ্য ভূমি দখল হয়েছে।
দখলদারিত্বের অবসান হলে অস্ত্র ছাড়বে হামাস
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস বলেছে, তারা অস্ত্র ছাড়তে রাজি। তবে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান হতে হবে। গতকাল সোমবার টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, হামাসের প্রধান আলোচক খলিল আল-হায়া বলেছেন, সংগঠনটির নিরস্ত্রীকরণের সঙ্গে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও আগ্রাসী উপস্থিতির সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ২০ দফা পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে হামাসকে অস্ত্র সমর্পণের শর্ত দিয়েছে।
ইসরায়েলের হামলা যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন নয়– বলছেন রুবিও
রয়টার্স জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন ঘটেনি বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। গতকাল সোমবার তিনি বলেন, গাজায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন ঘটেছে বলে ওয়াশিংটন মনে করে না।
কোনো দেশই গাজায় সেনা পাঠাবে না: জর্ডানের বাদশাহ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবের আওতায় গাজায় শান্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে কোনো দেশ আগ্রহী হবে না বলে মন্তব্য করেছেন জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শান্তিরক্ষা মানে হচ্ছে স্থানীয় ফিলিস্তিনি পুলিশকে সহায়তা করা, যা জর্ডান ও মিসর বড় পরিসরে করতে ইচ্ছুক। তবে এতে সময় লাগবে। কিন্তু যদি আমাদের গাজার রাস্তায় অস্ত্র হাতে টহল দিতে হয়, তাহলে কোনো দেশই এমন পরিস্থিতিতে জড়াতে চাইবে না। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, তারা গাজায় কোনো সেনা পাঠাবে না।
Your Comment